২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। কারণ সে সময় বাংলাদেশকে দেয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুল্কছাড় সুবিধা হারানোর ফলে দেশের রফতানির পরিমাণ সাড়ে ৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। বাংলাদেশ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা না পায়, তাহলে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত হতে পারে। ফলে এটা বলা যায় যে আগামী দিনে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে হলে দেশের রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করা ও একই সঙ্গে রফতানি বাণিজ্যের গন্তব্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই।
রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা রফতানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৭০ মিলিয়ন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। চামড়া ও অচামড়াজাত উভয় ধরনের পাদুকাই এ খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে চামড়াজাত পাদুকার রফতানি ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং অচামড়াজাত পাদুকার রফতানি ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১৫ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে রফতানি যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৯ ও ৬ দশমিক ১১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ ও ২৬০ মিলিয়ন ডলার। তা সত্ত্বেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসে সরকারের চামড়াজাত শিল্পের কৌশলগত রফতানি লক্ষ্য ১ হাজার ২৩৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারকে অতিক্রম করে ১ হাজার ২৭০ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সম্ভব হবে। তবে রফতানির এ ধারা অব্যহত রাখা এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য ব্যবসা পরিচালনায় রফতানিকারকরা যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন তা দূরীকরণে আশু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
শিল্প ঋণে সুদহার আগের ৯ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৩-১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা চরম সংকটে পড়েছেন। ফলে দেশে ব্যবসার প্রসার ঘটছে না, থমকে আছে বিনিয়োগ। বস্তুত ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশির
ভাগ উদ্যোক্তা। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, মার্কিন সরকারের নতুন ট্যারিফ প্ল্যান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ, রফতানি পণ্যের মূল্যহ্রাস, ভারতের ট্রানজিট সুবিধা বন্ধ ইত্যাদি কারণে শিল্পমালিকরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। পণ্য পরিবহনে খরচ কিলোমিটারপ্রতি বিশ্বের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে শিল্প খাতে এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। ব্যবসার এ খরচ কমাতে না পারলে আমরা সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না। অন্যদিকে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও বিদেশী ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াতে রাজি নন, বরং পণ্যের দাম কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। সুতরাং রফতানি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সার্বিকভাবে রফতানি শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উজ্জিবীত করার জন্য বেশকিছু প্রবৃদ্ধিমুখী পদক্ষেপ আসন্ন বাজেটে গ্রহণ করা দরকার।
১. আমদানিনীতি আদেশ ২০২১-২৪ অনুসারে তৈরি পোশাক শিল্পের অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোর রফতানি আদেশ সম্পাদনের জন্যে ক্রেতা কর্তৃক প্রেরিত বিনামূল্যে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা বিদ্যমান। তবে এলএফএমইএবির প্রতিষ্ঠানগুলো এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকায় তা রফতানি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প খাতকে বিনামূল্যে কাঁচামাল আনার সুবিধা প্রদান করা হলে তাতে কোনো প্রকার বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাঠানো না হলেও এর মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে রফতানিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে।
২. চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং স্পেশালাইজড শিল্প খাত হওয়া সত্ত্বেও তৈরি পোশাক শিল্পের ন্যায় আলাদা বিধিমালা না থাকায় এ খাতের রফতানিকারকদের কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রফতানিতে নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন তৈরি পোশাক শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ পদ্ধতির আওতায় কাঁচামাল আমদানি, ওয়্যারহাউজ পরিচালনা ও কার্যপদ্ধতি বিষয়ক আলাদা বিধিমালা রয়েছে, যা চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প খাতের নেই। সুতরাং সরাসরি রফতানিমুখী চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং, ওয়্যারহাউজ পদ্ধতির আওতায় কাঁচামাল আমদানি, ওয়্যারহাউজ পরিচালনা ও কার্যপদ্ধতি, বার্ষিক আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ সম্পর্কিত পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক, যা এ খাতে ব্যবসা সহজীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
৩. তৈরি পোশাক শিল্পে আমদানিযোগ্য কাঁচামালের আমদানি প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে উৎপাদনের আগে কাঁচামাল আমদানির জন্য ইউটিলিটি ডিক্লারেশন (ইউডি) অনুমোদন করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন যথা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে প্রদান করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের ন্যায় চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প খাতের আমদানিযোগ্য কাঁচামালের আমদানি প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে উৎপাদনের আগে কাঁচামাল আমদানির জন্য ইউডি অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। এ খাতের অ্যাসোসিয়েশন এলএফএমইএবিকে ইউডি প্রদানের দায়িত্বভার প্রদান করা হলে রফতানিকারকরা কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে অযথা সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি থেকে রক্ষা পাবেন।
ফলে লিড টাইম কমে আসবে এবং রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। সর্বোপরি এটি চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প খাত থেকে রফতানি আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
৪. বর্তমানে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের সহগ নির্ণয়ের জন্য এলএফএমইএবিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞ টিম রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে সহগ নির্ধারণের কাজে নিয়োজিত। এলএফএমইএবি স্বতন্ত্রভাবে সহগ নির্ণয় করতে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ডেডো ও এলএফএমইএবি যৌথভাবে সহগ নির্ণয় করা হচ্ছে। এ সমিতি তার সদস্যদের সহগসংক্রান্ত সব দায়ভার গ্রহণ করে। সুতরাং এলএফএমইএবিকে এর সদস্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহগ নির্ণয় ও জারি করার দায়িত্বভার এককভাবে অর্পণ করলে খুব স্বল্প সময়ে সহগ জারি করা সম্ভব হবে, ফলে পণ্য রফতানির লিড টাইম কমে আসবে।
৫. রফতানীমুখী খাতের বিদ্যমান রফতানি বাজারের শেয়ার রক্ষা ও সম্প্রসারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা ব্যবস্থাকে জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় এটি রফতানি বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতার অবনতি ঘটাবে এবং একটি সম্ভাবনাময় সেক্টরের বৃদ্ধিকে মন্থর করতে পারে, যা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে টেকসই উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
৬. এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সম্ভাব্য চিহ্নিত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মনিটরিং করার লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করে তাতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা করি আসন্ন বাজেটে সরকার চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে এবং সার্বিকভাবে রফতানি শিল্পের বহুমুখীকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেবে। এতে রফতানি খাতগুলো উজ্জীবিত হবে ও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।